বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ: সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
বিড়াল প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্তর্গত একটি রূপকধর্মী ব্যঙ্গাত্মক রচনা, যা ১২৮১ সালের চৈত্র মাসে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘শ্রী কমলাকান্ত চক্রবর্তী’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ও সামাজিক অসংগতির গভীর সমালোচনা করেছেন।
সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু:
প্রবন্ধে কমলাকান্ত, একজন সুবিধাভোগী ধনী শ্রেণির প্রতিনিধি, এবং একটি ক্ষুধার্ত বিড়াল, যে শোষিত ও নিপীড়িত দরিদ্র শ্রেণির প্রতীক, মুখোমুখি হয়। বিড়াল কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ খেয়ে ফেলে, যার ফলে কমলাকান্ত তাকে শাসন করতে যান। তখন বিড়াল যুক্তিপূর্ণভাবে প্রশ্ন তোলে—মানুষ ও বিড়ালের মধ্যে প্রভেদ কী? উভয়েরই ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে। বিড়াল বলে, ধনীদের অতিরিক্ত ধনসঞ্চয়ের কারণেই দরিদ্ররা চুরি করতে বাধ্য হয়। এই বৈষম্যের জন্য কৃপণ ধনীরা দায়ী। বিড়ালের বক্তব্যে সাম্যবাদের সুর প্রকাশ পায়, যা কমলাকান্তকে মর্মাহত করে। অবশেষে, কমলাকান্ত বিড়ালের যুক্তি মেনে নিয়ে তার সঙ্গে খাবার ভাগ করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ব্যাখ্যা:
- রূপকধর্মী ব্যঙ্গ: বঙ্কিমচন্দ্র বিড়াল ও কমলাকান্তের কথোপকথনের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক সমাজের শোষণ ও অসাম্যের সমালোচনা করেছেন। বিড়াল দরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে সমাজের অবহেলিত মানুষের কষ্ট ও প্রতিবাদ তুলে ধরে।
- সাম্যবাদের প্রতিফলন: বিড়ালের বক্তব্যে ফরাসি দার্শনিক রুশোর সাম্যবাদের প্রভাব স্পষ্ট। সে বলে, ধনীদের অপরিমিত সম্পদ সঞ্চয়ের কারণেই দরিদ্ররা অভাবে পড়ে এবং চুরি করতে বাধ্য হয়। এটি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রতিফলন।
- ধনী-দরিদ্র বৈষম্য: প্রবন্ধটি সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে আলোকপাত করে। বিড়ালের প্রশ্ন—‘খাইতে পাইলে কে চোর হয়?’—দরিদ্রদের অপরাধের পেছনে সামাজিক অবিচারকে দায়ী করে। ধনীদের কৃপণতা ও অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় এই বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
- হাস্যরসের ব্যবহার: বঙ্কিমচন্দ্র হাস্যরসের মাধ্যমে গভীর সামাজিক সমস্যাকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। কমলাকান্তের নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নেপোলিয়ন ও ওয়েলিংটনের কল্পনা, বিড়ালের সঙ্গে তার কথোপকথন—এসব হাস্যরস সৃষ্টি করে, কিন্তু এর মাধ্যমে গুরুতর সমাজ সমালোচনা উঠে আসে।
- নামকরণের সার্থকতা: ‘বিড়াল’ নামটি রূপকধর্মী। বিড়াল কেবল একটি প্রাণী নয়, বরং সমাজের শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণির প্রতীক। তার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র সমাজের অন্ধকার দিক ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন, যা নামকরণকে সার্থক করে।
উপসংহার:
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র হাস্যরস ও রূপকের মাধ্যমে সমাজের ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, শোষণ ও অসাম্যের সমালোচনা করেছেন। বিড়ালের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটায় এবং সমাজের অবহেলিত শ্রেণির কথা তুলে ধরে। এই প্রবন্ধ বঙ্কিমের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিভার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।